আজ শুক্রবার, ২৭শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পুলিশের হয়রানি ও তার সমাধান।

সম্পাদকীয়ঃ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ দেশ স্বাধীন হয়। আমরা মুক্ত হই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে ।স্বপ্ন দেখি স্বাধীন সোনার বাংলাদেশের। কিন্তু আজ আমরা কতটুকু স্বাধীন রয়েছি ,তা আমরা নিজেরায়ও জানি না। আমাদের দেশে ভি-আই-পি দের সংখ্যা একেবারে কম নয়, তাঁরা নিজেরাই নিজেদের পথ খুঁজে নিতে সক্ষম। আমার এই লেখাটি একেবারেই সাধারণ মানুষদের জন্যে লেখা, আশা করি আপনাদের কাজে আসবে।

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নাগরিকেরা নিজেদের অধিকার এবং আইন সম্পর্কে সচেতন নন, আর এই অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে থাকে কতিপয় দুর্নীতিবাজ এবং অসৎ পুলিশেরা। এই সব দুর্নীতিবাজ অসৎপুলিশদের অপকর্ম ঠেকাতে কঠোর বিভাগীয় শাস্তি যেমন প্রয়োজন , একইভাবে প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা । আপনি একটু সচেতন হলে নিজেই অনেক পুলিশি ঝামেলা থেকে বেঁচে যেতে পারবেন।

সন্দেহবশত, ৫৪ ধারায় যদি বিনা দোষে আপনাকে গ্রেফতার করা হয়- জেনে নিন, ২৪ ঘন্টার বেশি আপনাকে আটক করে রাখার উপায় নেই। এক্ষেত্রে সম্ভব হলে দ্রুত কোন আত্মীয়কে থানায় আসতে বলুন। অনেক সময় দেখা যায় বখাটেদের সাথে অনেক নিরীহ ছেলেও ধরা পড়ে। এক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় যদি থানায় এসে লিখিত দিতে পারে যে ধৃত ব্যক্তি তাঁর সাথে সম্পর্কিত, এবং সে যা পরিচয় দিচ্ছে সেটি সঠিক- এক্ষেত্রে আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন।

ধরে আনার কাজটা মূলত, করে কনস্টেবল থেকে এস-আই পর্যায়ের অফিসারেরা। একটি থানায় তাদের নেতা হচ্ছেন ওসি।আপনি যদি ওসির সাথে ( ওসি না থাকলে ইন্সপেক্টর-তদন্ত সাহেব) সরাসরি দেখা করে বা যোগাযোগ করে আপনার আত্মীয়ের নির্দোষিতা প্রমাণ করতে পারেন সেক্ষেত্রেও বিপদ কেটে যাবার কথা।

এবার সবচাইতে স্পর্শকাতর বিষয়ে কথা বলি, পুলিশ কর্তৃক নিরীহ মানুষকে আটক করে হয়রানির ভয় দেখিয়ে দুর্নীতি করার অভিযোগ খুব কমন এবং প্রচলিত। এসব ক্ষেত্রে যেটা হয়, ওই অসৎ অফিসার আপনাকে ভয় দেখান এবং আপনিও ভয়ে তার কথামত কাজ করেন। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ, বাংলাদেশ পুলিশ এবং ডিএমপি এ্যাপ, এই দুটি নিজের মোবাইলে রাখুন, সেই সাথে নিজ থানার ওসি/ ওসি তদন্ত / ডিউটি অফিসার – এদের নাম্বার রাখুন। আপনি যে এলাকার বাসিন্দা সে এলাকার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার/এসপি/সহকারী পুলিশ কমিশনার/ এএসপি – এঁদের ফোন নাম্বার অবশ্যই ফোনে সেইভ করে রাখুন।আপনি যদি বিনা কারণে আটক হন এবং আপনি নিজে বা আপনার কোন আত্মীয় যদি এই সিনিয়র অফিসারদেরকে ফোনে জানাতে পারেন- তিনি অবশ্যই খোঁজ নেবেন ব্যাপারটি কি সেটা জানতে। এঁদের কাছ থেকেও আপনি সহায়তা পেতে পারেন।

ধরে নিচ্ছি উপরের কোন স্টেপেই কোন কাজ হলনা, আপনি ওই অসৎ অফিসারের পাল্লায় পড়ে হয়রানির শিকার হলেন। এক্ষেত্রে আপনার কর্তব্য হচ্ছে ছাড়া পাবার পর পুরো ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ সহ লিখিত আকারে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট এলাকার ডেপুটি পুলিশ কমিশনার( মেট্রোপলিটন এলাকায় হলে) বা এসপি (জেলাতে) স্যার বরাবর পাঠানো। প্রয়োজনে আপনি সহকারী পুলিশ সুপার/ এডিশনাল এসপি এমনকী প্রয়োজনে এসপি/ ডেপুটি পুলিশ কমিশনার স্যারের সাথেও দেখা করতে পারেন। বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে ধাপে ধাপে স্বয়ং পুলিশ প্রধানের সাথে দেখা করার অধিকারও আপনার আছে। প্রয়োজন পড়লে এটি প্রয়োগ করুন।

প্র্যাকটিকাল টিপস হচ্ছে, কোন অবস্থাতেই মাথা গরম করবেন না, নমনীয় থাকুন। নমনীয়তা মানে দুর্বলতা নয়, এর মানে আপনি নিজেকে ওই কর্কশ ব্যবহারকারী দুষ্ট অফিসারের পর্যায়ে নামিয়ে নিচ্ছেন না। খুব শান্তভাবে এবং সুকৌশলে তার নাম জেনে নিন এবং পরবর্তীতে ওই অফিসারের সিনিয়র অফিসারের কাছে এ ব্যাপারে তথ্য দিন।

যে কাজটি করা থেকে বিরত থাকতে বারংবার অনুরোধ জানাচ্ছি সেটি হচ্ছে, বিপদ কেটে যাবার পর অন্যায়টিকে “হজম” করে ফেলা। ঘুষ দেয়া এবং ঘুষ নেয়া সমান অপরাধ- মাত্র ৫০০/১০০০ টাকা দিয়ে “ঝামেলা” এড়াতে এড়াতে আমরা প্রতিবাদ করতে ভুলে গিয়েছি, যথাস্থানে নালিশ জানাতে অস্বীকার করছি। আমরা যেটা করি তা হচ্ছে, ওই ৫০০/১০০০ টাকা ঘুষ বিনা প্রতিবাদে দিয়ে দিই। বরং আপনি যদি সুকৌশলে ওর নেমপ্লেট আর কাঁধের ব্যাজ-এ কয়টা দাগ আছে দেখে নিতেন(অথবা সুযোগ পেয়ে মোবাইলে ভিডিও/ছবি তুলে নিতেন)- এরপর সেগুলো দিয়ে তার উপর মহলে( ওসি ও তদোর্ধ্ব) নালিশ জানাতেন, তাতে ও ওই অপকর্মটি করার আগে দুইবার চিন্তা করত।

১৮২ ধারায় বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি যদি পুলিশ বা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে (সরকারি কর্মচারী) মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে বিভ্রান্ত করে কিংবা কোন সরকারি কর্মচারিকে দিয়ে কারো ক্ষতি বা বিরক্তি  করে, তাহলে সে ব্যক্তি ছয় মাসের কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয় বিধিতে- দণ্ডিত হবেন । ১৮২ ধারার কার্যক্রম পুলিশকে মিথ্যা খবর প্রদান, তার ফলে পুলিশে কিছু কার্যক্রম গ্রহণ এবং তার পর যদি সে খবর মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয় তা হলেই প্রযোজ্য হবে। এ ক্ষেত্রে কার বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু না করেও শুধু মিথ্যা খবর পরিবেশন করে পুলিশকে কোন কর্তব্য পালন করা বা করা থেকে বিরত থাকা কিংবা কোন ব্যক্তিকে হয়রানি করা হলেই অপরাধটি সংঘটিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে।

অন্যদিকে, দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুসারে কোন ব্যক্তি যদি কারো বিরুদ্ধে, মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে মামলা রুজু করান আর সে মামলা যদি তদন্তে বা বিচারে মিথ্যা প্রমাণিত হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি অপরাধটি সংঘটিত করেছেন বলে ধরে নেয়া হবে। এক্ষেত্রে যদি অভিযোগটি সাধারণ প্রকৃতির হয় তবে বাদীর দুই বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম জেল ও জরিমানা কিংবা উভয়বিধ সাজা হতে পারে। কিন্তু যে মিথ্যা অপরাধে তাকে হয়রানি করা হয়েছে তা যদি যাবজ্জীবন কিংবা সাত বছর পর্যন্ত জেলের শাস্তিযোগ্য হয়, তাহলে বাদীর সাত বছর পর্যন্ত জেল কিংবা জরিমানাসহ জেল হতে পারে।

১৮২ ধারা ও ২১১ ধারার মধ্যে পার্থক্য হল, ১৮২ ধারায় মিথ্যা খবর দেয়ার মধ্যে অপরাধটি সীমাবদ্ধ থাকে। অর্থাৎ পুলিশকে মিথ্যা খবর দিলেই অপরাধটি সংঘটিত হয়ে যাবে। কিন্তু ২১১ ধারায় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা রুজু করার পরে তা তদন্তে বা বিচারে মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ার পরেই অপরাধটি এ ধারায় শাস্তিযোগ্য হবে।

যে কথাটি বার বার বলি সেটিই আবার বলছি- ৪৫ বছরের জঞ্জাল এক দিনে যাবেনা। কিন্তু যখন পুলিশ বাহিনীর লোকজন  দেখবে, “আরে, আমাদের দেশের মানুষ তো আইন কানুন জানে, তাদের তো  ধমক দিয়ে হয়রানি করা যায় না!” তখন পুলিশের ভেতরেও পরিবর্তন আসবে।

বলাবাহুল্য মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত এই বাহিনী তার নানা সীমাবদ্ধতা সত্বেও জনকল্যানে কাজ করে যাচ্ছে।  সিদ্ধান্ত আমাদের আমরা কিরকম পুলিশ চাই- ভালো না খারাপ।

 

স্পন্সরেড আর্টিকেলঃ